পুরোপুরি নিজের শর্তে বাঁচার সত্যি গল্পের প্যান্ডোরার বাক্স এই
বিভাগ। সামনে অচেনা কয়েকজন, আর তাঁদের খেয়াল-খুশিতে ভরানো অনাবিল
যৌবন-যাপনের কাব্য| সম্পর্কের চেনা ফ্রেমে সে-সব ছবি আঁটে না, কিন্তু মেলে
এক বৃহত্তর জীবনের ইঙ্গিত| কিভাবে, কখন 'এলিয়েন' হয়ে গেলেন তাঁরা? নাকি
এই বাঁচাটাই স্বাভাবিক, যেটা সমাজের চোখ-রাঙানিতে আমরা স্বীকার করতে
পারিনি?
নীলোফারের ইচ্ছেডানার মন। ওর জীবনের ভুল-ঠিকের হিসেব ওর ইচ্ছে দিয়ে গাঁথা।
ওর সঙ্গের কফির চুমুকে আড্ডা দিতে গিয়ে কেবল এ কথাই মনে হচ্ছিল। ছাব্বিশের
এই মেয়ে মন ইচ্ছে নিয়ে রাতের বাইপাসে বন্ধু সঙ্গে বা একাই লরিচালকের ডেরায়
মাতাল হতে পারে আবার কর্পোরেট অফিসের ঝলমলে দপ্তরে মাথায় গামছা বেঁধে অফ
বিট পোশাকে সকলকে চমকে দিতে জানে।
‘বাড়িতে খুব ছোটবেলায় আলাদা করে কেউ কিছু আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। মা
নিয়মিত নামাজ পড়তেন কিন্তু আমাকে যে পড়তেই হবে এমনটা কখনও বলেননি। তবে
একবার স্কুলেই আমার এক বন্ধুর মা জানতে চেয়েছিলেন আমি বাঙালি না মুসলমান?
এটা আমায় খুব নাড়া দিয়েছিল! একটু ঘাবড়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবার কাছে আমার
সব প্রশ্নেরই তো উত্তর মিলত। বাবা বলে দিয়েছিলেন এমন কোনও প্রশ্ন আবার এলে
বলে দিতে আমি বাঙালি বা মুসলমান কোনটাই নই, আমি একজন মানুষ। এই মানুষ
হওয়ার জীবনে হিন্দু এবং মুসলমান দুই তরফেরই বিরাগভাজন হতে হয়েছে, হতে হবে
আমায় বারে বারে।
আমি বরাবরই বাবা-পাগল মেয়ে। আমার বাবা মেয়ে বলে কেবল গান, নাচ আর
পুতুলখেলা দিয়ে আমার ছোটবেলা কাটাতে দেননি, বরং আমার পুলিশে চাকরি করা,
বেগম আখতার শোনা রসিক বাবা খেলার মধ্যে দিয়ে আমার জীবনের মাঠকে অনেক বড় করে
চিনতে শিখিয়েছিলেন। আর ছোটবেলার এই খোলা মাঠের পাগলামি আজও আমায় যখন তখন
ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মদ খাওয়া নিয়ে বাবা কোনওদিন কিছু বলেননি। কলেজের ঠিক আগে
আগেই তার এই উড়ুক্কু মেয়েকে বাবা বলেছিলেন যা করবে নিজের দায়িত্বে, আমাকে
যেন তোমার আচরণের জন্যে কিছু করতে বা বলতে না হয়। আমিও যখন বন্ধু আড্ডা
থেকে বুঝতে পারি যে বাড়ি ফেরার অবস্থায় আজ আমি নেই সেদিন জানিয়ে দিই বাড়িতে
যে আমি আজ ফিরব না। আমি যেখানে যেভাবেই থাকি না কেন কালারফুল হ্যাপেনিং
লাইফ আমার চাই-ই চাই। কোনও পার্টি, বন্ধু আড্ডায় এমন করে সাজি যাতে সকলের
আমাকেই সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়বে। আমি জানি আমি ডাকসাইটে সুন্দরী নই। তাতে
কি? যেখানে আমার কমতি সেখানে আমি ঢুকতেই চাই না। নিজের ছায়া মস্ত করে,
অস্তাচলে বসে বসে নিজের জীবনকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একেবারেই
নেই।
এই কারণে আমার ধ্যাবড়া কাজল, সিগারেট খাওয়া, কথায় কথায় তথাকথিত মেয়েলি
নয় এমন শব্দ বা ‘গালাগালি’ দেওয়া চলন-বলন অনেকেরই অপছন্দ। একবার দিল্লিতে
একটা বিখ্যাত মিডিয়া কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়ে এও বলতে শুনেছি যে একলা
ফ্ল্যাট নিয়ে থাকা, সিগারেট খাওয়া, অফবিট পোশাক পরা, গালিগালাজ করা মেয়ে
মানেই সে যে কোনও পুরুষের সঙ্গে যখন খুশি বিছানায় যেতে পারে। যেন তার এই
অন্য ধারার একমাত্র কারণ হল তার সেক্সুয়াল ডিজায়ার! ওই পরিবেশে আমি টিঁকে
থাকতে পারিনি। সে যত বড় চাকরিই হোক আমার মন যা চায় আমি তাই করি। এমন বিরক্ত
হয়েছিলাম যে দিল্লি থেকে ফেরার পরে আর চাকরিই করিনি। নাটকের মধ্যে এদিক
সেদিক লেখালেখি করে দিব্যি দুরন্ত ঘূর্ণির মতো শহর চষে বেড়াতে লাগলাম। আমার
স্কুল থেকে কলেজের ভালবাসার সঙ্গী যেদিন আত্মহত্যা করল সেদিন থেকে প্রায়
টানা পাঁচ বছর কাউকে ভালবাসতেও পারিনি। কলেজটা পুরোটাই বন্ধু, ইউনিয়ন নিয়ে
ফূর্তিতে কাটিয়েছি। প্রেম, শরীর এগুলো তখন আমার কাছে সেভাবে আসেনি। আমার
বন্ধুরা সব্বাই জানে ইচ্ছে হলে যে কোনওদিন তিন-চার দিনের জন্যে মোবাইল থেকে
শুরু করে আমার সমস্ত নেটওয়ার্ক বন্ধ রেখে আমি মন খারাপ করে কোথাও চলেও
যেতে পারি আবার বাড়িতেই বসে থাকতে পারি। আমার ইচ্ছেই আমার প্রথম প্রেম'।
খানিক দম নিল ফুরফুরে মেয়ে। 'তারা ভরা আগুনরাতে অলি থেকে বেরিয়ে যে
অংশুমানের হাত ধরে ভরা পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় হঠাৎ ইচ্ছে হতেই আমরা
প্রাণখুলে চুমু খেয়েছিলাম তার অমন চলে যাওয়াটা আজও ভিতর গুলিয়ে দেয়
আমায়'.... বুঝলাম, মেয়ের জলের তলে পাহাড় ছিল, বুঝি লাগল বুকের অন্দরে।
'আসলে জান আমি যেমন বেয়াদপ, বেআক্কেলে মানুষ, আমাকে সামলানোরও দরকার।
তাই বোধহয় দীপ্তর সঙ্গে দেখা হল আমার। দীপ্ত আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। ও আমার
না বলা চাওয়াগুলোকে ধরতে পারে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার বাইরেটা
দেখে আমায় উড়নচণ্ডী মনে হলেও দিনের শেষে আমার একটা বন্ধ দরজার ঘর চাই। ওই
ঘর, ঘরের চাবি সব আমার দীপ্তর কাছে। খুব শিগগিরি আমরা বিয়ে করব। জানতে চাই
‘বিয়ে কেন? এই যে বলছিলে কেবল ইচ্ছে চাও। বাঁধন চাও না। বিয়েটা কি বাঁধন
নয়?’। ‘আসলে মা হতে চাই আমি। আমার মা বলে ওটাই নাকি জীবনের সবচেয়ে
কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। যে আসবে তাকে বিপদে ফেলতে চাই না। মনে পড়ে গেল
জীবনানন্দ- ‘মৃত্তিকার মতো তুমি আজ/ তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে’।
এই ইচ্ছেই নীলোফারকে বাইরের জগতে লাগামছাড়া করে দীপ্তর কাছে ফিরিয়ে
দিচ্ছে। আপাতত এক পুরুষের মেয়ে ও। আশৈশব বাবার মুগ্ধতা ওকে ভিতর বাহিরকে
বিপরীত করে গড়ে তুলেছে। মা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডপশনের কথাও ভেবেছে ও।
খুব অসহায়ের মতন আমাকে প্রশ্ন করল নীলোফার ‘আইনত কোনও হিন্দুকে বিয়ে করে
ধর্মান্তরিত হলেই আমি অ্যাডপশনের আইনের আওতায় আসব? কেন?’ ওর চোখে দেখি আবার
নিয়ম ভাঙার সুর। ‘যেভাবেই হোক, আমি কেবলমাত্র মানুষ থেকেই অ্যাডপ্ট করে
দেখাব দেখো!’
ওর জন্যে রইল শ্রীজাতর শব্দেরা-
সে খুব পাকা। পরনে পোস্টার।
শরীর জুড়ে বিক্ষোভ আর দাবি
চুলখোলা, তাঁর স্নান না করা, আর
ঘাসের আগে মনখারাপের নাভি
এমনিতে সে তাতমেজাজি। ধুস।
কুরুশ দিয়ে চোখের পাতা বোনা
কাছে গেলেই জড়িয়ে ঝুপ্পুস...
এবং তাকে বশ করা গেলনা
কবিতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর শ্রীজাত