বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষা সংখ্যার বিচারে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। পাঁচ
বছর আগেও আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর
পর্যায়ে সাধারণ, কারিগরি, চিকিৎসা, প্রকৌশল সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান ছিল প্রায় পাঁচ লাখ। সে সংখ্যা বর্তমানে ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা
আগের তুলনায় চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় যে
বিপ্লব সাধিত হয়েছে তার অনেক কারণ আছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সাধারণ
মানুষের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতি বিশেষ সচেতনতাবোধ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে এই
বিশ্বায়নের যুগে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বিকল্প মানুষ ভাবতে পারে না। বিশ্বে
কর্মমুখী শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয় আমাদের আগ্রহ দিন দিন
বাড়ছে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে কোনো কাজে টেকনিশিয়ান কিংবা ইলেকট্রিশিয়ান
খোঁজ করা হলে একজন ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী কিংবা কোনো ডিগ্রি ব্যতীত সাধারণ
একজন টেকনিশিয়ানের শরণাপন্ন হতে হতো। এখন কিন্তু চেহারা পাল্টে গেছে।
দেশের বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসে চাকরির ক্ষেত্রে দেখা যেত, কারিগরি দক্ষ
কর্মীর জন্য কোনো ওয়ার্কশপে কাজ করার অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট রয়েছে কিনা।
কিন্তু এখন বিষয়টি আমূল পাল্টে গেছে। এখন যে কোনো কর্পোরেট অফিসে
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার চাওয়া হয়। ফলে চাকরি প্রার্থীর গুণগত মানও বৃদ্ধি
পাচ্ছে। চাকরিপ্রার্থীরা কারিগরি প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে কোর্স
সম্পন্ন করে চাকরির আবেদন করছে। এতে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বাড়ছে।
আজকাল জ্ঞান অর্জনের চেয়ে ভালো একটি চাকরির উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের
প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। কিছুকাল ধরে এই প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের
দেশে প্রায়োগিক শিক্ষা প্রদানের সুযোগ খুব একটা নেই। এতে আমাদের দেশ অনেক
দিক থেকে পিছিয়ে আছে। অনেক সময় দেখা যায়, একজন মাস্টার্স করা শিক্ষার্থী
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ট্রাফিক পুলিশের চাকরি করছে, যার জন্য
মাত্র এসএসসি পাসই যথেষ্ট; এ ক্ষেত্রে আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে
বিচারে বলা যায়, আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত মান উন্নত হয়নি; কিছুটা
ঘাটতি রয়েছে। যদিও বছরে গড়ে ২০ লাখ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে
কিন্তু তাদের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষার সুযোগ কম থাকায় আমাদের শিক্ষার্থী
শুধু একাডেমিক জ্ঞানই অর্জন করছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বিত যে উন্নতি
হয়েছে তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেক ঘাটতি রয়েছে।
আরও একটি কথা আছে, এই ২০ লাখ শিক্ষার্থী প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত না হলেও
যদি লিবারেল আর্টসের ওপর শিক্ষা অর্জন করত, তবে সে নিজেই তার জীবিকা
অর্জনের পথ বের করে নিত। হয়তো তার প্রকৌশল, পুরকৌশল বা প্রযুক্তির
মাথাভরা জ্ঞান না থাকতে পারত কিন্তু তার ভেতরে যে শক্তি, উদ্ভাবনীর চিন্তা
থাকত, তখন তার নিজের কাজ সে নিজেই খুঁজে বের করত। সেখানে আমাদের একটা
সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমাবদ্ধতা হলো_ আমরা গুণগত উচ্চশিক্ষা দিতে এখনো অক্ষম।
দেশে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেগুলোতে বিশ্বমানের প্রায়োগিক শিক্ষা
প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সব স্নাতক বের হচ্ছে,
তাদের চাকরির কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো, এমন কিছু
বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটের মূল্য সেভাবে নিরূপিত
হয় না বা হয়নি। বিষয়টি পাবলিক এবং প্রাইভেট উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে
সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাহলে আমাদের শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? একজন
শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটের কোনো মূল্যই থাকল না, তখন আমাদের
উচ্চশিক্ষার মানকে আমরা কীভাবে উন্নত বলব।
সংখ্যার বিচারে আমাদের শিক্ষার মান বেড়েছে, তবে বিস্তৃতির দিক দিয়ে বেশ
ঘাটতি রয়েছে, যেমন সেই বিস্তৃতিটা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। জ্ঞান
এবং প্রযুক্তি একইসঙ্গে অর্জন করতে হবে। আমরা প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু
জ্ঞানের পথে হাঁটলে জীবনের জন্য ভালো হবে কিন্তু জীবিকার জন্য নয়। সুতরাং,
আমাদের উচ্চশিক্ষার বর্তমান বিস্তৃতি এমন হতে হবে, যাতে জীবনের সব ক্ষেত্রে
প্রায়োগিক দিকটা যেন সমন্বিত হয়।
পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে যদি তাল
মিলিয়ে চলতে না পারি, তবে যে জ্ঞান আমরা অর্জন করলাম কার্যত তার কোনো মূল্য
থাকবে না। আবার তিন বছর আগের প্রযুক্তি নিয়েও যদি বসে থাকি, সে প্রযুক্তি
বিকল। অচল জ্ঞান আর বিকল প্রযুক্তি নিয়ে আমরা কতদূর যেতে পারব। আশার কথা
এই, বর্তমানে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, জেনিটিক
সায়েন্স ছাড়াও আরও যেসব বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, তা সবই প্রযুক্তিনির্ভর।
বর্তমান সরকারের তিন বছরে ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যেখানে
প্রযুক্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, আমরা
লিবারেল আর্টস কিংবা সামাজিক বিজ্ঞান পড়ব না। আমি সামাজিক বিজ্ঞানে যদি
স্নাতক হই এবং একইসঙ্গে কমিউনিকেশন স্কিলটা শিখে নেই তাহলে স্নাতকরা নিজের
পথ খুঁজে নিতে পারবে।
বাংলাদেশ মধ্যায়ন মানের দেশের পথে বেশ দ্রুততার সঙ্গেই চলছে। এখন যদি গুণগত
শিক্ষাটা দেওয়া যায় তাহলে অচিরেই আমরা একটি ভালো পর্যায়ে পেঁৗছব। রেটিং
করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্থিক সচ্ছলতা, শিক্ষার মান ইত্যাদির সঙ্গে এখন
বাংলাদেশের নামও চলে এসেছে। কারণ এ দুটো রেটিংয়ে আমাদের দেশের অবস্থা বেশ
সন্তোষজনক। আর বিশ্ব পরিমণ্ডলে ১১টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ
অন্যতম। কিছুদিন আগে বিশ্ব মার্কেটিং গুরু কর্টলার বলেছেন, বাংলাদেশ হতে
পারে চীন কিংবা ভারতের সমমানের দেশ। তার কথা থেকে বোঝা যায়, দেশের
অবকাঠামো, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সামগ্রিক উন্নয়নে আমরা অনেকদূর
এগিয়েছি। আমরা চীন, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, ক্যারিবিয়ান দেশের গুরুত্বপূর্ণ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিট করছি। ফার্মাসিউটিক্যাল, গার্মেন্ট, টেঙ্টাইল,
লেদার টেকনোলজিতে এগিয়েছি। এসব কিছু থেকে বুঝতে হবে বাংলাদেশ ঝড়-ঝাপটা,
খরা, সিডর, আইলা, রাজনৈতিক সহিংসতা এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের তরুণরা এগিয়ে
যাচ্ছে। এ দেশের বহু শিক্ষার্থী বিশ্বের সেরা শিক্ষা, গবেষণা ও ব্যবসায়িক
প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশের মুক্তির পতাকাকে তারা
বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে।
বিগত কয়েক বছরের তুলনায় গত তিন বছরে শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। দেশের
বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুণগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য চেষ্টা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইউজিসি এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় ৯০০ কোটি
টাকার প্রজেক্ট দিয়ে গবেষণা সহযোগিতা করছে। দেশের প্রায় ৫৪টি প্রাইভেট
বিশ্ববিদ্যালয় এ সুযোগ পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের মাঝারি পর্যায়ের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের একাডেমিক কার্যক্রম বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা, জার্নাল প্রকাশ, ভালো গবেষণার জন্য পুরস্কৃত
করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার মান উন্নয়নে সদা তৎপর। আমি হতাশাবাদীদের দলে
নই, আমি আশাবাদী এবং বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়ে যাবে।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন