বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী
৪০ রানে ৩ উইকেটের পতন। স্বপ্নটা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছিল। তামিম-সাকিবের ৭৬ রানের জুটি কক্ষপথে ফেরাল বাংলাদেশ দলকে
ছবি: শামসুল হক
কে
বলল, শুধু চ্যাম্পিয়নরাই ‘ল্যাপ অব অনার’ দেয়! বাংলাদেশ দল যে ফাইনালে
উঠেই ‘ল্যাপ অব অনার’ দিয়ে ফেলল! কী আশ্চর্য, সেটি একটুও বেখাপ্পা লাগল না।
বরং কী সুন্দর! কী সুন্দর! কী সুন্দরই না লাগল সেই দৃশ্য! আনন্দ আর
উচ্ছ্বাসের ভেলায় ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে মিরপুর
স্টেডিয়াম। আর গ্যালারিতে উঠছে ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ গর্জন।
সেই গর্জন মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে তখন ছড়িয়ে পড়েছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়। ক্রিকেট বিশ্বেও কী নয়! বাংলাদেশ তো বাঘের গর্জনে প্রকম্পিত করে তুলেছে পুরো ক্রিকেট দুনিয়াই। আগের ম্যাচে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের দর্প চূর্ণ। এই ম্যাচে বিশ্বকাপ রানার্সআপদের। যে এশিয়া কাপে ‘বড় তিন ভাই’য়ের দাপটে চিরকালীন ‘চতুর্থ’ দল হয়ে ছিল বাংলাদেশ, যে এশিয়া কাপে এর আগে একটিও বড় জয় ছিল না, সেই এশিয়া কাপের একাদশতম সংস্করণটি এলো বাংলাদেশের জন্য অবিস্মরণীয় এক উপহার নিয়ে। বাংলাদেশ ফাইনালে!
প্রথম ম্যাচে যে পাকিস্তানের বিপক্ষে হাতের মুঠোয় আসা জয় ফসকে গেছে, আগামীকাল ফাইনালে তারাই প্রতিপক্ষ। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটে দিন বদলের গান হয়ে থাকে, এই এশিয়া কাপ এলো আত্ম-আবিষ্কারের ঘোষণা হয়ে। সেই ঘোষণার সাক্ষী হয়ে থাকলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাস গড়ার মুহূর্তটার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকতে স্টেডিয়ামে ছুটে এলেন শেখ হাসিনা। ফিরলেন অবিস্মরণীয় এক অনুভূতিকে সঙ্গী করে। যে অনুভূতির রেণু গায়ে মেখেই কাল রাতে ঘুমিয়েছে পুরো বাংলাদেশ।
এমনিতেই এই ম্যাচকে ঘিরে অনিশ্চয়তা আর রোমাঞ্চের অভাব ছিল না। বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হলো বৃৃষ্টি। শ্রীলঙ্কান ইনিংস শেষ হতেই উইকেট ঢাকা পড়ল ত্রিপলে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর দর্শকদের অধীর প্রতীক্ষা। খেলা আর না হলেও সমস্যা ছিল না। অতিরিক্ত একটা দিন রাখাই ছিল। কিন্তু সাধারণ দর্শকদের কজন তা জানত! উৎকণ্ঠা তাই অধিকার করে নিল সবাইকে। বৃষ্টি না বাংলাদেশের স্বপ্নকে ধুয়েমুছে নিয়ে যায়!
শেষপর্যন্ত যখন খেলা শুরু হলো, লক্ষ্য একটু কঠিনতরই হয়ে গেল। ৫০ ওভারে লক্ষ্য ছিল ২৩৩। রাত আটটায় বাংলাদেশ ইনিংস শুরু হলো ডাকওয়ার্থ-লুইসে ৪০ ওভারে ২১২ রানের পরিবর্তিত লক্ষ্য নিয়ে। ওভার কমল ১০টি, রান মাত্র ২১।
আশা-নিরাশায় ভেলায় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। বৃষ্টির আবেশমাখা উইকেটে লাসিথ মালিঙ্গা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবেন না তো! নুয়ান কুলাসেকেরা আছেন। আছে শ্রীলঙ্কার বিচিত্র সব স্পিনারকূল। হবে তো?
মালিঙ্গাকে কোনোমতে সামলানো গেল। কিন্তু বড় ধাক্কা দিলেন কুলাসেকেরা। দ্বিতীয় ওভারেই নাজিমউদ্দিন নেই। পরপর দুই ওভারে ১ রানের ব্যবধানে জহুরুল ও মুশফিকুরও। অষ্টম ওভারের শুরুতেই স্কোরবোর্ডে ৩ উইকেটে ৪০। স্বপ্নের গায়ে তখন সংশয়ের ছায়া।
সেটিকে উড়িয়ে দেওয়ার কাজটা করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই রাজকুমার। তামিম ইকবালকে নিয়ে এই টুর্নামেন্টের আগে অনেক নাটক হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বিতর্ক তাঁর ছায়াসঙ্গী। আগের দুই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেই এর জবাব দিয়েছিলেন। কাল ২৩তম জন্মদিনে বাঁহাতি ওপেনার খেললেন টুর্নামেন্টে তাঁর সেরা ইনিংসটি। লাকমলকে টানা তিন বলে চার মেরে ড্রেসিংরুমে ছড়িয়ে দিলেন আত্মবিশ্বাসের হাওয়া। মাহারুফকে দুর্দান্ত এক স্ট্রেট ড্রাইভে ইনিংসের অষ্টম চারে ৪৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি। ১১২ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে এই প্রথম টানা তিন ম্যাচে পঞ্চাশ।
চতুর্থ উইকেটে ৭৬ রানের জুটিতে তামিমের সঙ্গী তাঁর প্রিয় বন্ধু সাকিব আল হাসান। যাঁর কাছে প্রতিটি দিনই নতুন রূপে দেখা দেওয়ার উপলক্ষ। প্রতিটি ম্যাচই নিজেকে নতুন করে চেনানোর সুযোগ। ‘নতুন’-ই বা বলেন কিভাবে! সাকিব তো এই কাজ করে যাচ্ছেন আশ্চর্য ধারাবাহিকতায়। কালও ঝলমলে বাংলাদেশ দলে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নামটি তাঁর। বোলিংয়ে ২ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাটিংয়ে ৫৬ রানে ম্যান অব দ্য ম্যাচ। তামিমের চেয়ে দ্রুততর তাঁর হাফ সেঞ্চুরি, মাত্র ৪৩ বলে।
তামিম-সাকিবের বীরত্বের পরও ম্যাচে অনিশ্চয়তা ছিল। তামিমের আউটটি বেশি গায়ে লাগেনি তখনো সাকিব আছেন বলে। কিন্তু শুরু থেকেই তাঁকে ঝামেলায় ফেলা সাচিত্রা সেনানায়েকের অফ স্পিন যখন সাকিবের প্রাণ কেড়ে নিল, ম্যাচ পেন্ডুলামে দোদুল্যমান। হোটেলে অপেক্ষায় থাকা ভারতীয় দলে আশার আলো।
সেটি নিভিয়ে দেওয়ার কাজটা কী দারুণভাবেই না করলেন নাসির ও মাহমুদউল্লাহ! অপরাজিত ৭৭ রানের জুটিটি যেন পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে বানানো। ১৭ বল বাকি থাকতেই জয়ের সুবর্ণ বন্দর। দিলশানের বলে নাসিরের শটটি সীমানা পেরোতেই মাঠে ছুটে এলেন বাংলাদেশের বাকি সব খেলোয়াড়। ফ্লাডলাইটের আলোতে দৃশ্যটা কেমন যেন অপার্থিব লাগছিল!
প্রথম দুই ম্যাচে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে আগেই বিদায় নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। তার পরও মোটেই সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না ওরা। সাকিব ভয় পাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কান ব্যাটিংয়ের ত্রিমূর্তিকে। যারা এখন ব্যাটিং অর্ডারের এক-দুই-তিন। ভয় পাওয়ার মতোই তিন ব্যাটসম্যান। এই ম্যাচের আগে ওয়ানেডেতে জয়াবর্ধনে, দিলশান ও সাঙ্গাকারার মোট রান ২৭,৪৯৩। সেঞ্চুরি ৪০টি। অঙ্ক দুটিই অনেক কিছু বলছে। এর সঙ্গে যোগ করুন তিন জনের প্রত্যেকের একাই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা।
দশম ওভারের মধ্যেই হিপ-হিপ-হুররে। জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা-দিলশান তিন জনই নেই! সম্মিলিত অবদান ৩০ রান। শ্রীলঙ্কা ৩ উইকেটে ৩২ রানের অতল গহ্বরে। এক প্রান্ত থেকে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন মাশরাফি। তবে উইকেট নেওয়ার কাজটা একাই করলেন নাজমুল। আবারও মনে করিয়ে দিলেন তাঁর ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা। অভিষেক সেই ২০০৪ সালে। সাড়ে সাত বছরে এটি তাঁর মাত্র ৩৭তম ওয়ানডে। এই সময়ে বাংলাদেশ খেলেছে ১৬৮টি ম্যাচ!
সুযোগ পেলেই ভালো খেলেছেন। কিন্তু কখনো চোট, কখনো বা দলের সমন্বয়ের মারপ্যাাঁচে টানা দুটিও ম্যাচও খেলতে পেরেছেন খুব কমই। এই ম্যাচেও যেমন সুযোগ পেয়েছেন কাঁধে চোট পেয়ে শফিউল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ায়। নিজেকে দুর্ভাগা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে নাজমুলের। তবে বাংলাদেশ দলের জন্য এই পেসারই আবার সৌভাগ্যের প্রতীক। কালকের আগে যে ৩৭টি ম্যাচ খেলেছেন, বাংলাদেশ জিতেছে তার ১৭টিতেই। এর মধ্যে বড় দলের বিপক্ষে জয় ৬টি। সংখ্যাটা ১৮ আর ৭ হয়ে গেল কাল।
স্বপ্নের একটা শুরু করে দিয়েছিলেন নাজমুল। সেই স্বপ্নটা ক্রমশ পরিপূর্ণতার পথে এগিয়েছে আরও অনেকের সম্মিলিত অবদানে। চতুর্থ উইকেটে প্রতিরোধ গড়ে তোলা থিরিমান্নে ও কাপুগেদারাকে ফিরিয়েছে রাজ্জাকের বাঁহাতি স্পিন। প্রথম ও দ্বিতীয় স্পেলে এলোমেলো শাহাদাত তৃতীয় স্পেলে নিভিয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কান ব্যাটিংয়ের শেষ বাতি থারাঙ্গাকে। পরপর দুই ওভারে বিপজ্জনক দুই টেল এন্ডার মাহারুফ ও কুলাসেকেরাকে বধ করে সাকিব দ্রুততর করেছেন শ্রীলঙ্কান ইনিংসের সমাপ্তি। মাশরাফি একটা উইকেট না পেলে সেটি বড় অন্যায় হতো। শেষ ওভারে সিংহহূদয় এই ক্রিকেটারও বুঝে পেলেন প্রাপ্য পুুরস্কার। সেটি ওভারের প্রথম বল। পঞ্চম বলে রান আউটে শেষ শ্রীলঙ্কান ইনিংস।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই সাকিব আল হাসান বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। বলেছিলেন দুষ্টুমি করে। বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকেই সেটি বুঝতে পারেননি। এখন সাকিব দাবি করতেই পারেন, ‘আমি তো বুঝেশুনেই বলেছিলাম।’ এশিয়া জয়ের স্বপ্নটা এখন আর অলীক কল্পনা নয়। চ্যাম্পিয়ন তো হতেই পারে বাংলাদেশ। আর একটা ম্যাচই তো!
এখন আর স্বপ্নে লাগাম পরানোর সময় নয়। এখন সময় স্বপ্নের পাখা মেলে ওড়ার।
শ্রীলঙ্কা: ৪৯.৫ ওভারে ২৩২
বাংলাদেশ: ৩৭.১ ওভারে ২১২/৫
ফল: বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী (ডি/এল)
সেই গর্জন মিরপুর স্টেডিয়াম থেকে তখন ছড়িয়ে পড়েছে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায়। ক্রিকেট বিশ্বেও কী নয়! বাংলাদেশ তো বাঘের গর্জনে প্রকম্পিত করে তুলেছে পুরো ক্রিকেট দুনিয়াই। আগের ম্যাচে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের দর্প চূর্ণ। এই ম্যাচে বিশ্বকাপ রানার্সআপদের। যে এশিয়া কাপে ‘বড় তিন ভাই’য়ের দাপটে চিরকালীন ‘চতুর্থ’ দল হয়ে ছিল বাংলাদেশ, যে এশিয়া কাপে এর আগে একটিও বড় জয় ছিল না, সেই এশিয়া কাপের একাদশতম সংস্করণটি এলো বাংলাদেশের জন্য অবিস্মরণীয় এক উপহার নিয়ে। বাংলাদেশ ফাইনালে!
প্রথম ম্যাচে যে পাকিস্তানের বিপক্ষে হাতের মুঠোয় আসা জয় ফসকে গেছে, আগামীকাল ফাইনালে তারাই প্রতিপক্ষ। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটে দিন বদলের গান হয়ে থাকে, এই এশিয়া কাপ এলো আত্ম-আবিষ্কারের ঘোষণা হয়ে। সেই ঘোষণার সাক্ষী হয়ে থাকলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাস গড়ার মুহূর্তটার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকতে স্টেডিয়ামে ছুটে এলেন শেখ হাসিনা। ফিরলেন অবিস্মরণীয় এক অনুভূতিকে সঙ্গী করে। যে অনুভূতির রেণু গায়ে মেখেই কাল রাতে ঘুমিয়েছে পুরো বাংলাদেশ।
এমনিতেই এই ম্যাচকে ঘিরে অনিশ্চয়তা আর রোমাঞ্চের অভাব ছিল না। বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হলো বৃৃষ্টি। শ্রীলঙ্কান ইনিংস শেষ হতেই উইকেট ঢাকা পড়ল ত্রিপলে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর দর্শকদের অধীর প্রতীক্ষা। খেলা আর না হলেও সমস্যা ছিল না। অতিরিক্ত একটা দিন রাখাই ছিল। কিন্তু সাধারণ দর্শকদের কজন তা জানত! উৎকণ্ঠা তাই অধিকার করে নিল সবাইকে। বৃষ্টি না বাংলাদেশের স্বপ্নকে ধুয়েমুছে নিয়ে যায়!
শেষপর্যন্ত যখন খেলা শুরু হলো, লক্ষ্য একটু কঠিনতরই হয়ে গেল। ৫০ ওভারে লক্ষ্য ছিল ২৩৩। রাত আটটায় বাংলাদেশ ইনিংস শুরু হলো ডাকওয়ার্থ-লুইসে ৪০ ওভারে ২১২ রানের পরিবর্তিত লক্ষ্য নিয়ে। ওভার কমল ১০টি, রান মাত্র ২১।
আশা-নিরাশায় ভেলায় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। বৃষ্টির আবেশমাখা উইকেটে লাসিথ মালিঙ্গা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবেন না তো! নুয়ান কুলাসেকেরা আছেন। আছে শ্রীলঙ্কার বিচিত্র সব স্পিনারকূল। হবে তো?
মালিঙ্গাকে কোনোমতে সামলানো গেল। কিন্তু বড় ধাক্কা দিলেন কুলাসেকেরা। দ্বিতীয় ওভারেই নাজিমউদ্দিন নেই। পরপর দুই ওভারে ১ রানের ব্যবধানে জহুরুল ও মুশফিকুরও। অষ্টম ওভারের শুরুতেই স্কোরবোর্ডে ৩ উইকেটে ৪০। স্বপ্নের গায়ে তখন সংশয়ের ছায়া।
সেটিকে উড়িয়ে দেওয়ার কাজটা করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুই রাজকুমার। তামিম ইকবালকে নিয়ে এই টুর্নামেন্টের আগে অনেক নাটক হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বিতর্ক তাঁর ছায়াসঙ্গী। আগের দুই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেই এর জবাব দিয়েছিলেন। কাল ২৩তম জন্মদিনে বাঁহাতি ওপেনার খেললেন টুর্নামেন্টে তাঁর সেরা ইনিংসটি। লাকমলকে টানা তিন বলে চার মেরে ড্রেসিংরুমে ছড়িয়ে দিলেন আত্মবিশ্বাসের হাওয়া। মাহারুফকে দুর্দান্ত এক স্ট্রেট ড্রাইভে ইনিংসের অষ্টম চারে ৪৬ বলে হাফ সেঞ্চুরি। ১১২ ওয়ানডের ক্যারিয়ারে এই প্রথম টানা তিন ম্যাচে পঞ্চাশ।
চতুর্থ উইকেটে ৭৬ রানের জুটিতে তামিমের সঙ্গী তাঁর প্রিয় বন্ধু সাকিব আল হাসান। যাঁর কাছে প্রতিটি দিনই নতুন রূপে দেখা দেওয়ার উপলক্ষ। প্রতিটি ম্যাচই নিজেকে নতুন করে চেনানোর সুযোগ। ‘নতুন’-ই বা বলেন কিভাবে! সাকিব তো এই কাজ করে যাচ্ছেন আশ্চর্য ধারাবাহিকতায়। কালও ঝলমলে বাংলাদেশ দলে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নামটি তাঁর। বোলিংয়ে ২ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাটিংয়ে ৫৬ রানে ম্যান অব দ্য ম্যাচ। তামিমের চেয়ে দ্রুততর তাঁর হাফ সেঞ্চুরি, মাত্র ৪৩ বলে।
তামিম-সাকিবের বীরত্বের পরও ম্যাচে অনিশ্চয়তা ছিল। তামিমের আউটটি বেশি গায়ে লাগেনি তখনো সাকিব আছেন বলে। কিন্তু শুরু থেকেই তাঁকে ঝামেলায় ফেলা সাচিত্রা সেনানায়েকের অফ স্পিন যখন সাকিবের প্রাণ কেড়ে নিল, ম্যাচ পেন্ডুলামে দোদুল্যমান। হোটেলে অপেক্ষায় থাকা ভারতীয় দলে আশার আলো।
সেটি নিভিয়ে দেওয়ার কাজটা কী দারুণভাবেই না করলেন নাসির ও মাহমুদউল্লাহ! অপরাজিত ৭৭ রানের জুটিটি যেন পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে বানানো। ১৭ বল বাকি থাকতেই জয়ের সুবর্ণ বন্দর। দিলশানের বলে নাসিরের শটটি সীমানা পেরোতেই মাঠে ছুটে এলেন বাংলাদেশের বাকি সব খেলোয়াড়। ফ্লাডলাইটের আলোতে দৃশ্যটা কেমন যেন অপার্থিব লাগছিল!
প্রথম দুই ম্যাচে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে আগেই বিদায় নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। তার পরও মোটেই সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না ওরা। সাকিব ভয় পাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কান ব্যাটিংয়ের ত্রিমূর্তিকে। যারা এখন ব্যাটিং অর্ডারের এক-দুই-তিন। ভয় পাওয়ার মতোই তিন ব্যাটসম্যান। এই ম্যাচের আগে ওয়ানেডেতে জয়াবর্ধনে, দিলশান ও সাঙ্গাকারার মোট রান ২৭,৪৯৩। সেঞ্চুরি ৪০টি। অঙ্ক দুটিই অনেক কিছু বলছে। এর সঙ্গে যোগ করুন তিন জনের প্রত্যেকের একাই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা।
দশম ওভারের মধ্যেই হিপ-হিপ-হুররে। জয়াবর্ধনে-সাঙ্গাকারা-দিলশান তিন জনই নেই! সম্মিলিত অবদান ৩০ রান। শ্রীলঙ্কা ৩ উইকেটে ৩২ রানের অতল গহ্বরে। এক প্রান্ত থেকে দুর্দান্ত বোলিং করেছেন মাশরাফি। তবে উইকেট নেওয়ার কাজটা একাই করলেন নাজমুল। আবারও মনে করিয়ে দিলেন তাঁর ভাগ্য বিড়ম্বনার কথা। অভিষেক সেই ২০০৪ সালে। সাড়ে সাত বছরে এটি তাঁর মাত্র ৩৭তম ওয়ানডে। এই সময়ে বাংলাদেশ খেলেছে ১৬৮টি ম্যাচ!
সুযোগ পেলেই ভালো খেলেছেন। কিন্তু কখনো চোট, কখনো বা দলের সমন্বয়ের মারপ্যাাঁচে টানা দুটিও ম্যাচও খেলতে পেরেছেন খুব কমই। এই ম্যাচেও যেমন সুযোগ পেয়েছেন কাঁধে চোট পেয়ে শফিউল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ায়। নিজেকে দুর্ভাগা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে নাজমুলের। তবে বাংলাদেশ দলের জন্য এই পেসারই আবার সৌভাগ্যের প্রতীক। কালকের আগে যে ৩৭টি ম্যাচ খেলেছেন, বাংলাদেশ জিতেছে তার ১৭টিতেই। এর মধ্যে বড় দলের বিপক্ষে জয় ৬টি। সংখ্যাটা ১৮ আর ৭ হয়ে গেল কাল।
স্বপ্নের একটা শুরু করে দিয়েছিলেন নাজমুল। সেই স্বপ্নটা ক্রমশ পরিপূর্ণতার পথে এগিয়েছে আরও অনেকের সম্মিলিত অবদানে। চতুর্থ উইকেটে প্রতিরোধ গড়ে তোলা থিরিমান্নে ও কাপুগেদারাকে ফিরিয়েছে রাজ্জাকের বাঁহাতি স্পিন। প্রথম ও দ্বিতীয় স্পেলে এলোমেলো শাহাদাত তৃতীয় স্পেলে নিভিয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কান ব্যাটিংয়ের শেষ বাতি থারাঙ্গাকে। পরপর দুই ওভারে বিপজ্জনক দুই টেল এন্ডার মাহারুফ ও কুলাসেকেরাকে বধ করে সাকিব দ্রুততর করেছেন শ্রীলঙ্কান ইনিংসের সমাপ্তি। মাশরাফি একটা উইকেট না পেলে সেটি বড় অন্যায় হতো। শেষ ওভারে সিংহহূদয় এই ক্রিকেটারও বুঝে পেলেন প্রাপ্য পুুরস্কার। সেটি ওভারের প্রথম বল। পঞ্চম বলে রান আউটে শেষ শ্রীলঙ্কান ইনিংস।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই সাকিব আল হাসান বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। বলেছিলেন দুষ্টুমি করে। বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকেই সেটি বুঝতে পারেননি। এখন সাকিব দাবি করতেই পারেন, ‘আমি তো বুঝেশুনেই বলেছিলাম।’ এশিয়া জয়ের স্বপ্নটা এখন আর অলীক কল্পনা নয়। চ্যাম্পিয়ন তো হতেই পারে বাংলাদেশ। আর একটা ম্যাচই তো!
এখন আর স্বপ্নে লাগাম পরানোর সময় নয়। এখন সময় স্বপ্নের পাখা মেলে ওড়ার।
শ্রীলঙ্কা: ৪৯.৫ ওভারে ২৩২
বাংলাদেশ: ৩৭.১ ওভারে ২১২/৫
ফল: বাংলাদেশ ৫ উইকেটে জয়ী (ডি/এল)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন