রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১২

চীনের প্রতিরক্ষা ব্যয় কোথায় গিয়ে থামবে???

  1. ২০১০ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং জিইচি। তাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের খবরদারি নিয়ে নানা অভিযোগের মুখে পড়েন তিনি। অসংখ্য নালিশের জবাব সামাল দিতে গিয়ে হঠাত্ বোকার মতো তিনি বলে ওঠেন, ‘চীন একটি বিশাল দেশ। অন্য দেশগুলো ছোট, আর এটাই প্রকৃত কারণ।’ তাঁর কথা ঠিক। ভৌগোলিক ও জনসংখ্যার দিক থেকে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দেশ চীন। কিন্তু সামরিক শক্তির দিক থেকেও দেশটির ওপর কেউ নেই এ অঞ্চলে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ধীরে ধীরে পাখা মেলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সেনাবাহিনী।
    চীন দ্রুত তার সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন করছে; এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর পেছনে দেশটি ঠিক কত ব্যয় করছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। গত দুই দশকে দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিপ্রি) মতে, ২০০০ সালে চীনের প্রতিরক্ষা ব্যয় ছিল তিন হাজার কোটি ডলার। ১০ বছর বাদে তা প্রায় চার গুণ বাড়ে। ২০১০ সালে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় গিয়ে ঠেকে ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে। অবিশ্বাস্য! তার পরও ওই হিসাবটিতে গবেষণা এবং উন্নয়ন খাতের ব্যয় ধরা হয়নি। গবেষণা ও উন্নয়ন খাত অন্তর্ভুক্ত করা হলে ২০১২ সালে দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় দাঁড়াবে ১৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মতো। এখনো প্রতিরক্ষা খাতে সবচেয়ে বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রই। তবে চীন যেভাবে এগোচ্ছে তাতে ২০৩৫ সালের পর দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
    চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী। ২৩ লাখ সক্রিয় সদস্য নিয়ে এটি গঠিত। পেন্টাগনের থিঙ্কট্যাঙ্ক ভাবছে, চীন এখন দূর থেকে শত্রু সেনাকে ধ্বংস করার শক্তি অর্জনের পথে। তাদের সামরিক সরঞ্জামে যুক্ত হচ্ছে জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, আধুনিক ডুবোজাহাজের বহর এবং আকাশ পথে স্যাটেলাইট বিধ্বংসী অস্ত্র—যা সুদূর অবস্থান থেকে যেকোনো দেশের সামরিক শক্তিকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম।
    চীনের এই প্রস্তুতি দেখে মনে হয়, দেশটি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ওকিনাওয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও গুয়ামে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি এবং বিমানবাহী রণতরীকে তাক করেছে। এতে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে এ অঞ্চলে মার্কিন মিত্ররাও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর খুব একটা নির্ভর করতে পারবে বলে মনে হয় না। এদিকে বহুদিন ধরে তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার বিরোধিতা করে আসছে চীন। এ অবস্থায় তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে চীন তাইওয়ান আক্রমণ করে বসতে পারে।
    দিন দিন অগ্রসরমাণ চীনের সামরিক শক্তি এশিয়ায় সতর্ক সংকেত দিচ্ছে এবং মূলত এটাকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে মার্কিন প্রতিরক্ষা নীতি। এ জন্য গত জানুয়ারিতেই বারাক ওবামা ও তাঁর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা এশিয়া নিয়ে তাঁদের নতুন ‘কৌশলগত পথনির্দেশনা’ (স্ট্র্যাটেজিক গাইডেন্স) প্রকাশ করেছেন। আগামী ১০ বছরে দেশটি প্রতিরক্ষা ব্যয় থেকে ৫০ হাজার কোটি ডলার ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা রয়েছে সেখানে। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত ওই নির্দেশনায় এটাও আছে যে, সম্ভাব্য হুমকি প্রতিরোধ করতে এবং এ অঞ্চলে মার্কিন শক্তি প্রদর্শনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই সম্ভাব্য সব কিছু করবে।
    মার্কিনিদের ওই কৌশলপত্রে কী আছে সেটা খুব পরিষ্কার। এত দিন ইরাক ও আফগানিস্তান নিয়ে মগ্ন থাকা দেশটি চীনের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ সামরিক শক্তির দিকে খুব একটা নজর দেয়নি। মার্কিন জ্যেষ্ঠ কূটনৈতিকদের মতে, এ অঞ্চলে খবরদারি করার ব্যাপারে চীনের একটি উচ্চাভিলাষ আছে। দেশটি চায় অন্য কেউ যেন এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব দেখাতে না পারে। অন্যদিকে রুজভেল্টের সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আর হয়তো সেই ধারাবাহিকতা থেকেই ওবামা গত নভেম্বরে ঘোষণা দিয়েছেন শিগগিরই অস্ট্রেলিয়ায় আড়াই হাজার মার্কিন মেরিন সেনা নামবে।
    চীনের বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এবং কীভাবে ও কী কাজে দেশটি তার এই বাহিনীকে ব্যবহার করবে কিংবা কে এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আছে—এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ববাসীর মনে। চীনও তাই উদ্বিগ্ন যে কীভাবে বিশ্বকে পরিষ্কার একটা ধারণা দেওয়া যায় এ নিয়ে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত পথনির্দেশনায়’ এরই মধ্যে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে—‘বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে চীনকে তার উদ্দেশ্যটাও পরিষ্কার করতে হবে। আর এ অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়াতে এটা খুবই জরুরি।’

    অবশ্য কাগজে-কলমে চীন তার প্রতিশ্রুতি রাখতে বাধ্য। এ নিয়ে তার একটি পুরোনো স্লোগান রয়েছে। যেটাকে দেশটি বলে থাকে ‘শান্তিপূর্ণ বেড়ে ওঠা’। চীনের দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকেরা সব সময় নিয়মতান্ত্রিক বহু মেরুর একটি বিশ্বব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকেন। তবে তাঁরা যে নিজেদের সামরিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ করতে চান তা স্বীকার করতে চান না।

    কিন্তু তা স্বীকার না করলেও দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন সাগরে দেশটির আচরণ ভিন্ন সংকেত দেয়। গত দেড় বছরে সামুদ্রিক সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকার অধিকার নিয়ে চীনের জাহাজ ও নৌযানের সঙ্গে জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ফিলিপাইনের নৌযানের সংঘর্ষ লেগে রয়েছে। এ সব ঘটনার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে চীনের রাষ্ট্রচালিত গ্লোবাল টাইমস পত্রিকার একটি সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, ‘এই দেশগুলো যদি চীনের সঙ্গে তাদের বর্তমান আচরণ পরিবর্তন না করে, তবে তাদেরকে শিগগিরই কামানের গর্জন শুনতে প্রস্তুত হতে হবে। যদি এটাই দ্বন্দ্ব নিরসনের একমাত্র পথ হয় তবে সেজন্য আমাদেরকেও (চীন) তৈরি থাকতে হবে।’ এই বক্তব্যটা সরকারি কোনো ঘোষণা ছিল না। কিন্তু, এ ধরনের ঝগড়াটে মনোভাবের সম্পাদকীয় দেখে মনে হয়, চীনের গণমাধ্যম দেশটির জাতীয় স্বার্থে যেকোনো কিছু বলার পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। কারণ গণমাধ্যমও সেখানে পুরোপুরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত।
    গ্লোবাল টাইমসের এমন বক্তব্যে চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের বাকপটু ও স্মার্ট কর্মকর্তারা বিব্রত হলেও পত্রিকাটির মতামত প্রকাশে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। চীনের এই পত্রিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে অনেকটা ফক্স নিউজের মতোই আচরণ করে।
    চীনের সেনাবাহিনী বলে, ‘সক্রিয়ভাবে আত্মরক্ষা করা তাদের অত্যাবশ্যকীয় কৌশল।’ কিন্তু, তারাই বলে, ‘আমাদের জাতীয় স্বার্থে কেউ আঘাত দেওয়ার অর্থ হলো তারাই আমাদেরকে প্রথমে গুলি ছুড়েছে।’ সে ক্ষেত্রে পিপলস লিবারেশন আর্মির বক্তব্য হলো, ‘শত্রুর ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতে রাজি আমরা।’

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন